বরাক ভুবনের গণমানসে অনির্বাণ দীপশিখা রূপে
একষট্টির উনিশে মে । পূর্ববর্তী বছরগুলিতেও আমরা আত্মানুসন্ধানে আত্মসমালোচনা
করেছি । তাতে আমাদের মাতৃভাষা প্রেম বা দেশপ্রেমে কোনও খাদ ছিল না, যদিও দৃষ্টিভঙ্গির
সীমাবদ্ধতায় অসম্পূর্ণতা থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব হয়নি । ১৯৬১ এর ৫ই ফেব্রুয়ারি
করিমগঞ্জ শহরে অনুষ্ঠিত জনসম্মেলনে ভাষা সংগ্রাম পরিচালনার জন্য ‘কাছাড় গণসংগ্রাম পরিষদ’ এর জন্ম হয়েছিল ।
সংগ্রাম পরিষদের দাবি ছিল- আসাম রাজ্যে বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাজ্য ভাষার স্বীকৃতি দিয়ে রাজ্য ভাষা বিলের
সংশোধন । মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ফল হিসাবে শাস্ত্রী
ফর্মুলায় রাজ্যভাষা আইন সংশোধিত হয়েছিল ঠিকই , তবে তাতে কাছাড় গনসংগ্রাম পরিষদের দাবি আদায়
হয়নি অর্থাৎ আসাম রাজ্যে অন্যতম রাজ্য ভাষা রূপে বাংলাভাষার স্বীকৃতি মিলেনি, শুধু বরাক উপত্যকার জন্য
বাংলা ভাষার রাজনৈতিক- প্রশাসনিক স্বীকৃতিটুকু মিলেছিল । প্রবল গণ আন্দোলনের চাপের ফলে বরাকের
সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা কৃষ্টিগত অধিকার কেন্দ্র স্বীকার করে নিয়েছিল । কিন্তু
মাতৃভাষার ন্যায্য অধিকারের যথাযথ মর্যাদা রক্ষার মূল দাবিটি পূরণ করা হয়নি । সেই
সংগ্রাম আজও অপূর্ণ রয়ে গেছে ।
মাতৃভাষার মর্যাদারক্ষার সংগ্রামে ‘ উনিশ মে’ কিন্তু হঠাৎ আসেনি । গত
একশো বছরের ইতিহাস একথাই বলে যে বরাক উপত্যকা বরাবরই ছিল উপেক্ষিত এবং আসামে
বাঙালিদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক বইশম্য বঞ্চনা ছিল খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার ।
স্বাধীনতার পর থেকে এই উপত্যকাকে কেন্দ্র ও রাজ্যের নয়া উপনিবেশ রূপে ব্যবহার করা
হয়েছে । বর্তমান ও ভবিষ্যতের প্রজন্মের কাছে উনিশের বার্তা পৌঁছে দিতে হলে
সংগ্রামের পারিপার্শ্বিকতা অবশ্যই তুলে ধরতে হবে । তাই আলোচনায় ইতিহাসের প্রসঙ্গ
নিশ্চিতভাবে উঠে আসবে ।
এই
অঞ্চলের স্বায়ত্তশাসনের দাবি নূতন হয় । বহুজাতিক, বহুভাষিক এই রাজ্যটিকে এক ভাষা- ভাষী ও এক সাংস্কৃতিক
পরিচিতিতে নিয়ে যেতে বদ্ধ পরিকর শাসকদল ও গোষ্ঠী বহুকাল আগে থেকেই এ বিষয়ে সজাগও
সক্রিয় ছিল । সমতল ও পর্বতের অনসমিয়া ভাষাভাষী জাতি-উপজাতি গোষ্ঠী স্বৈরাচারী আক্রমণ ও সাংস্কৃতিক
আগ্রাসনের ব্যাপারে শঙ্কিত হয়ে পৃথক হতে চেয়েছিল- সেও অনেককাল আগের কথা । দেখা যাচ্ছে ১৯৩৮ সালেই
কাছাড়, লুসাই পার্বত্য এলাকা, মণিপুর ও ত্রিপুরা
মিলিয়ে পূর্বাঞ্চল প্রদেশ গঠনের দাবি উঠেছিল । ব্যাপক জনসমর্থিত এই দাবি অল ইনডিয়া
কংগ্রেস কমিটির কাছে পেশ করা হয়েছিল । পেশ করেছিল এই সব অঞ্চলের শাখা কংগ্রেস কমিটিগুলি । কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি যথাযথ
পরীক্ষা নিরীক্ষার পর এই দাবি অনুমোদন করে সংগঠনের গঠনতন্ত্রে এই অঞ্চলগুলির
সমাহারে ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠনের বিষয়টি গ্রহণ করেছিল । তবে এই সময়ে ভারতের
সংবিধান রচনার জরুরি কাজটির জন্য সাময়িকভাবেই বিষয়টি চাপা পড়ে যায় । অবশ্য কংগ্রেস
ওয়ার্কিং কমিটি তখনই নির্দেশ দেন যে কাছাড় ও ত্রিপুরার বাংলা ভাষা ও মণিপুরে
মণিপুরী ভাষার উপর হাত দেওয়া চলবে না ।
( তথ্যসূত্র : আসামের উপেক্ষিত : এপ্রিল ১৯৫৫ ইং কাছাড় রাজ্য পুনর্গঠন সমিতি, শিলচর )
১৯৬১ এর ভাষা সংগ্রামের পরিচালক সংগঠনের জন্মদাতা জনসম্মেলনের ( ৫ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৬১ ) ৩নং প্রস্তাবে আছে- যদি বাংলাকে আসামের
অন্যতম রাজ্য ভাষা না করা হয় তবে কাছাড় জেলাকে প্রয়োজন বোধে সংলগ্ন অন্যান্য
অনসমীয়া ভাষাভাষী অঞ্চল সহ রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন করে স্বতন্ত্র প্রশাসনিক সংস্থা
গঠন করা হোক । প্রতি দশকেই কোনও না কোনোওভাবে বাংলাভাষী এই ভূখণ্ডের স্বাতন্ত্র
বৈশিষ্টসূচক স্বায়ত্তশাসনের দাবি উঠে আসছে । কেন ব্যাপক জনসমাজ বা একাংশ থেকে
বারবার পৃথক হবার ইচ্ছা প্রকাশিত হয় ? কী তার প্রেক্ষিত ? উনিশের আলোকে এ বিষয়েও বিস্তৃত আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে ।
উনিশের উত্তরাধিকারের ভাবনার বোধ হয় এটাই সবচেয়ে জরুরি । একটি জাতি বা
বিভিন্ন জাতির নিজস্ব ভাষা যথার্থ মর্যাদাবঞ্চিত হলে যে অবমাননা হয় সেটা যে কোনও
আত্মসচেতন জাতি বা জাতি গোষ্ঠীর পক্ষে দুঃসহ ব্যাপার । স্বাধীনতার পর থেকে আজ
পর্যন্ত ক্রমাগত আক্রান্ত হচ্ছে আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতি । আসাম থেকে একে একে সরে
গিয়ে পার্বত্য উপজাতিরা পৃথক রাজ্য গড়ে নিয়েছে কেন্দ্রের আনুকূল্যে । সমতলীয়দের
মধ্যে বোডোদের অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম একদিকে সন্ত্রাসবাদের বাঁকা রাস্তা ধরেছে
অন্যদিকে এই সংগ্রামের একাংশ আপসের পথ ধরে নির্বাচনের মাধ্যমে সরকারের অংশভাগী ।
কারবি ও ডিমাছার আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবিতে সোচ্চার । বরাক উপত্যকা এখনও লেজুড় হয়ে
ঝুলছে । নিরাশাব্যঞ্জক এই প্রেক্ষাপট আশার বাতি একটাই – এখানে ভাষা ও সংস্কৃতির শিখাটি দেদীপ্যমান
রয়েছে । আর্থ- রাজনৈতিক ক্ষেত্রে রাজ্যস্তরীয় আধিপত্যদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ এখনও দানা
বাঁধেনি । শিক্ষা ক্ষেত্রে চোরাগোপ্তা আক্রমণ অবিরাম চলছে । ঠিক এই জায়গাটিতেই
আমাদের ভাষার অধিকার কতটা ব্যাহত হচ্ছে
এবং আসাম রাজ্যে বাংলা ভাষাকে কীভাবে পঙ্গু করে দেবার ব্যবস্থা সরকারিভাবে
চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে তা গভীরভাবে দেখা প্রয়োজন । সুপরিকল্পিত এই চক্রান্তের
বিরুদ্ধে প্রতিবাদ যেভাবে এবং যতখানি গর্জে ওঠার কথা ছিল তা কিন্তু হচ্ছে না । এর
একটি কারণ হতে পারে বর্তমানে শিক্ষাব্যবস্থায় মাতৃভাষার গুরুত্ব অনেকখানি হ্রাস
পাওয়া, যার প্রতিফলন লক্ষ্য করা
যায় মধ্যবিত্ত সমাজ জীবন বৃত্তে । বর্তমান সময়ে সমাজে যে বিরাট অংশ রয়েছে এর বাইরে
তারা অনুবাদের মাধমে বিকৃত বাংলাকে মাতৃভাষা বলে গ্রহণ করার বিপদ ভবিষ্যতের পক্ষে
কতখানি মারাত্মক হয়ে উঠবে তা ভেবে দেখা ও প্রতিকারের ব্যবস্থা দরকার । গণআন্দোলন
দ্বারা গণসচেতনতা সৃষ্টির উদ্যোগ নেওয়াটাই বোধ করি এই বিপদজনক সময়ের দাবি ।
সভ্যতার বিস্তারের সময়ে ক্রমে অতীতে ভাষা ও
সাংস্কৃতিক পরিচয়ে যে বিশাল অখণ্ড বঙ্গভূমির জন্ম হয়েছিল সেই বৃহৎ বঙ্গের আদি
বাঙালির আত্মপরিচয় অর্জনের সময়ে, জাতিত্ব গঠনের কালে রাষ্ট্রপ্রাধান্য নিরামক শক্তি ছিল না । সমাজ সংগঠনই ছিল
প্রকৃতিগত এই মিলনের মূল ধাত্রী । সাহিত্য এই স্বাভাবিক মিলনের বার্তাবহ রূপে কাজ
করেছিল । ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’ চিরায়ত এই বানীর প্রচার ও প্রসার ঘটিয়েছিল । অবশ্য আমাদের বাঙালি জাতীয় চেতনা
মূর্ত হয়েছিল বঙ্গভঙ্গ রোধ আন্দোলনের সময় ১৯০৫ সালে – তার আগে ঘনবদ্ধ হয়েছিল বাংলার নবজাগরণ জাগানো
উনিশ শতকের ভাবান্দোলনে । বঙ্কিমচন্দ্র বাংলার ইতিহাস লিখেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন
ভারতবর্ষের ইতিহাস যেখানে সমাজ সংগঠনই ছিল ইতিহাসের নিরামক শক্তি ।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় বৃহৎ বঙ্গ ভেঙে তিন টুকরো হয়ে গেল । সে এক বিপন্ন সময়
। গোটা পূর্ববঙ্গ রাতারাতি ভিন্ন রাষ্ট্ররূপে পূর্বপাকিস্তান নামে পাকিস্তানের অংশ
হয়ে গেল । বঙ্গভূমির নূতন নাম হল পশ্চিমবঙ্গ আর সমগ্র উত্তর পূর্বাঞ্চলের মধ্যে
বাংলাভাষা ভাষী মানুষদের বাসভূমি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল মূল থেকে । তখন থেকেই
ভ্রান্তিক অঞ্চল রূপে বঙ্গভাষাভাষী এই ভূখণ্ডের মানুষ অস্তিত্বের সঙ্কটে নিপতিত
হলো । আমাদের ইতিহাস আর ভূগোলের মধ্যে সৃষ্টি হলো এক কৃষ্ণ গহ্বরের – আমরা অনস্তিত্বের শিকার
হলাম । পশ্চিমবঙ্গ আর পূর্ববঙ্গ সাধারণ মানুষদের কাছে পরিচিত হলো এপার বাংলা আর
ওপারে বাংলা নামে । এই গণ্ডির বাইরে পড়ে রইল বিশাল এক ভূখণ্ড যার কোনও নাম নেই । দীর্ঘদিনের রক্তস্নাত ভাষা-সংগ্রামের ফলে সচেতন
বরাক উপত্যকার মানুষ নিজেরাই নাম দিয়েছেন ইশান বাংলা । পশ্চিমবঙ্গ, উত্তরবঙ্গ, দক্ষিণবঙ্গ এই নামগুলি
দেশ পরিচিত হতে পারে তবে ‘ইশান বাংলা’ কেন নয় ? ‘ইশান বাংলা’র চৌহদ্দির মধ্যে ত্রিপুরা রাজ্যও পড়ে । তবে সেটা তো স্বতন্ত্র রাজ্য । সেই
রাজ্যে বাংলাভাষার কোনও বিপদ
নেই । বরাক উপত্যকার কবি সাহিত্যিকরা আপন অঞ্চল ভূমিকে ‘তৃতীয় ভুবন’ বলতে অভ্যস্ত । খুব ভালবেসে তারা এই নামে ডাকেন
জন্মভূমি মা’কে । এভাবেই রাজনীতির পাশাখেলায় জনজীবনে আসে বিপর্যয় । প্রবল ঝড় ঝঞ্চার আকারে
আসা এমন সব বিপদে মানুষ তবু পরাজয় মানে না । বাংলা ভাষার এমনই প্রাণশক্তি, এমনই বিচিত্র তার
অভিযাত্রা যে এই ভাষা কোনদিনই লুপ্ত হবে না জানি, তাই বরাক উপত্যকার মাতৃভাষাপ্রেমী মানুষ রক্ত
ঝরিয়েও ভাষার মর্যাদা ও অধিকার রক্ষা করবে । এই ভাষা ও সংস্কৃতির আছে অক্ষয় পরমায়ু
। প্রয়োজন শুধু আমাদের সদা জাগ্রত থাকা । উনিশের উত্তরাধিকারে আছে বাঙালি অখণ্ড
ভাষা সংস্কৃতির চেতনা, আছে বরাক উপত্যকার বাঙালি জাতি সত্তার ঘনবদ্ধ হবার প্রেরণা ।আমরা এই উপত্যকার
হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের
মানুষ ‘বাঙালি’ বলে আত্মপরিচয় দিয়ে
বলীয়ান হই, হই গরীয়ান ।